কথামালা
#দুর্গাপুজো -২০২০
#দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে
@জয়িতা হালদার ঘোষ
(১)
ঘুম ভেঙেই সকালের রোদের আভাসে শরীর-মন স্নিগ্ধ হয়ে উঠলো উদিতার। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো,আজ দশমী।বিজয়া দশমী।গত কয়েকদিনের উৎসবের শেষদিন। এরপর কি হবে?
গত দীর্ঘ সাতমাস ধরে যে কাজের অভাব ছিল,মাত্র কয়েকটা দিন তা ঘুচেছিল ,মা দুর্গার পুজোর আবহে। কিন্তু কাল থেকে কি হবে? একটা ছোট্ট বুটিকের মালকিন পুজোর জন্য বেশী লোক প্রয়োজন বলে তাকে কাজ দিয়েছিলেন, বুটিকের শাড়ি-কুর্তি-গয়নার সম্ভার ক্রেতাদের দেখানোর জন্য। কিন্তু ,পুজোর শুরু থেকেই খরিদ্দার কমছিল। গতকালই ঐ মালকিনদিদি, বলেছেন,আজই কাজটার শেষদিন।এখন তো আর এত ভিড় থাকবে না।তাই তাকেও আর দরকার নেই।আরো একজন মেয়ে আছে -- ওঁনার পরিচিত পরিবারের।তাকে দিয়েই সব কাজ চলে যাবে।
একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে, ঘরের কাজ সারতে সারতে উদিতা ভাবলো আর কি-- আবার লোকের দোরে দোরে ঘুরে কাজ জোগাড় করতে হবে এবার।অসুস্থ বাবাকে নূন্যতম ওষুধ খাবারটা তো দিতেই হবে তাকে।
*********************************
(২)
ও মিনি ,আজ তো দশমী।তোমার সবকটা জামাই তো পরা হলো না।কি হবে? আমাকে বরং দুটো জামা দিয়ে দাও । আমার তো একটাও নতুন জামা হয় নি এবার পুজোয়।
ছোট্ট বছর তিনেকের মিনি, চোখদুটোতে দুষ্টুমি মাখিয়ে বললো,না না। ও সব তোমার গায়ে হবে না। তুমি বরং মায়ের এই শাড়িটা নিয়ে নাও।
দুর্গাষষ্ঠীর দিন, এই ঋতু নামের বছর দশেকের মেয়েটি- কাজ করতে এসেছে তাদের বাড়িতে।এখন ক'দিন বাড়িতে দুর্গাপুজো বলে ওকে রাখা হয়েছে টুকটাক কাজে মা-জেঠিমাদের সাহায্য করবে বলে। কিন্তু ,ও ছোট বলে--ওর সাইজের জামাটা কিনে দেওয়া হয় নি।ঋতু বললো,না রে বোকা।আমি শাড়ি নিয়ে কি করবো? আজই তো তোদের বাড়ির কাজ শেষ।মা এসে নিয়ে চলে যাবে।আর ঐ শাড়ি পেলেই নিয়ে নেবে।জানো তো,ও আমার সৎ মা। নিজের মা মরে গেছে, তাই বাবা আবার ওকে বিয়ে করেছে।এই ক'দিন তোমাদের বাড়িতে খুব ভালো লাগলো।মিনির মনে বড় কষ্ট হলো, বুঝতে পারলো সৎ মা ব্যাপারটা ভালো না।ঋতুদিদির চোখে জল দেখে বললো,চলো আমাদের সঙ্গে তুমিও কলকাতায় চলো। আমাদের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু ,তা তো সম্ভব নয়--ঋতুর সৎ মা এত সহজে এই মেয়েকে হাতছাড়া করবেই না। আবার নতুন কোন কাছাকাছি বাড়ি খুঁজে কাজে লাগিয়ে দেবে।ওর সংসার তো চালাতে হবে ওর প্রতিদিনের রোজগারের টাকায়। এতদিন লকডাউন থাকায় সংসার চলছে না তো আর।ঋতুর বাবার শিয়ালদহ স্টেশনের মুটেগিরির কাজটা যে বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে।
*********************************
(৩)
উঃ বাঁচা গেল। এতদিন ধরে পুজো পুজো হুল্লোড়টা শেষ হলো।ভাল্লা গে না।কেন যে লোকে এই মহামারীর সময়ও এভাবে মাতামাতি করছে কে জানে!আসলে মারণরোগ ঘরে ঢোকেনি তো ওদের। আমাদের বাড়ীতে তো সবাই এখনো সুস্থই আছে। কিন্তু রোগ ঢুকতে কতক্ষণ!
যাক্ , কোনরকমে চারটে দিন পার করে দিয়েছি।ঘরে সবাইকে আটকে রাখতে পেরেছি।ব্যস্ ।আর কি। এবার আবার নিত্যদিনের রুটিন।হ্যাঁ ,মানসী বাদে দুই ছেলে, আমি রোজ না হলেও সপ্তাহে দু'দিন তো বাজার দোকান আরো নানা কাজে বেরোবোই। কিন্তু এই উৎসব-উৎসব ব্যাপারটা ঠিক ভালো লাগে না আমার।বৌ ছেলেরা একটু বিরক্ত হয় ঠিকই। কিন্তু আমার হুকুম।মানতেই হবে।আগে বাঁচি রোগের হাত থেকে।তবে আবার পরের বছর আনন্দ করা যাবে।
আরে ,চললে কোথায় ?মানসী বললো,যাই মায়ের বরণটা সেরে আসি।আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম ।আরে ,যে জন্য ঘর থেকে ঠাকুর দেখতে গেলাম না , তুমি সেই চললে মন্ডপে? তোমার বলিহারি আক্কেল তো?
সব চুপচাপ হয়ে গেল বটে কিন্তু , মিনিটখানেকের মধ্যে হুড়মুড় করে কি যেন পড়ে গেল! দৌড়ে গিয়ে দেখি ছাদের ল্যান্ডিং এর ঠাকুর ঘরের যে সিঁড়ি, সেইখানে পড়ে আছে আমার বৌ মানসী। তাড়াতাড়ি ছুট্টে গিয়ে চোখেমুখে জল ছিটিয়ে ছেলেদের ডাকতেই ওরাও টিভি- কম্পিউটার ছেড়ে উঠে এলো ঠিকই। কিন্তু ততক্ষণে আমার বৌ ট্রিটমেন্টের বাইরে চলে গেছে।আজ তো বিজয়া দশমী।মায়ের সঙ্গে মায়ের মেয়েও বোধহয় কৈলাস যাত্রা করলো।হায় রে,এ কেমন পুজো দেখালি মহামায়া?
*********************************( (৪)
ও মা ,দেখো দেখতে দেখতে দশমীও এসে গেল।কালই ফিরে যেতে হবে আমাকে পুনেতে।এই ক'টা দিন কি ভালো কাটলো বলো তোমাদের সঙ্গে! রূপালী মায়ের গলা জড়িয়ে আদর করে বললো।ওর মায়ের দুচোখে জল।সত্যি ,উমা যেমন বাপের বাড়ি ঘুরতে আসে মোটে চারদিনের জন্য।তুইইও তোর অফিস থেকে মাত্র চারদিনই ছুটি পাস আমাদের কাছে আসার জন্য।হ্যাঁ মা, এরপরের বছর তো বিদেশেই চলে যাবো।তাই নতুন চাকরি হলেও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এই পুজোর চারটে দিন ম্যানেজ করতে পারলাম এবার।বাবা চলে গেছে, তুমি তো একেবারে একা।তাই না আসলে আমার খুব কষ্ট হতো মা।তবে সামনের বছর কিছু একটা ব্যবস্থা করেই দেবো আমি যাতে পুজোর ক'টা দিন একটুও খারাপ না লাগে তোমার।
নাও,এবার নাড়ুগুলো , আর কুচো গজা ,নিমকি সবই তো তৈরী করা শেষ আমার জন্য সুন্দর করে প্যাকিং করো তো মা। তুমি রোজ আমাকে ভিডিও কল করবে আর পুজোর ক'দিনের আনন্দের ছবিগুলো দেখবে। একদম মনখারাপ করবে না কিন্তু।
*********************************( (৫)
বাবি,কাল থেকে কি হবে রে? প্যান্ডেল তো খোলা হয়ে যাবে দুদিনের মধ্যে। তারপর আর কাজ পাবি? এখন পুজো ছোট করে হচ্ছে বলে বেশি লোক তো নিচ্ছে না প্যান্ডেল বাঁধার কাজে!
মা, অত চিন্তা করো না তো।দেখো আমি ঠিক অন্য কোন কাজ জুটিয়ে নেবো। তোমারও ফুলের মালা গাঁথার কাজটা বোধহয় বন্ধ হয়ে যাবে? না? কি আর করবে বলো,দেখি যদি ধূপকাঠির কারখানায় লোক নেয় আবার।মন্দির গুলোতে আগের মতো ভিড় হয় না বলে ধূপকাঠির বেচাকেনাও তো কমে গেছে।কি যে হবে কে জানে? এই দুগ্গাপুজোটা আর ক'দিন বেশি চললে আমাদের দুবেলা ভাতের চিন্তাটা থাকতো না বলো? চলো , শেষবারের মতো ,দুগ্গা মাকে একটু প্রণাম করে বলে আসি--- আসছে বছর একটু তাড়াতাড়ি এসো আর এ বছরটা ভাতের যোগাড়টুকু অন্ততঃ দিও রোগভোগ দূর করো মা।
*********************************
(৬)
মাম্মা, এরপর কি পুজো ? কেন জনি? না, আমার তো সব ড্রেস পরাই শেষ হলো না।বাপি কত্ত সুন্দর সুন্দর ড্রেস কিনে দিলো।মার্লিন বললো,এই দুর্গাপুজো চলে গেল আবার কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো সবই তো আছে বাকি।তবে আমাদের তো প্রতি মাসেই তিন- চারটে পার্টি থাকে সোনা। নতুন ড্রেসগুলো পরে নিও তখনই।
পাশের ঘরে ডাইনিং টেবিল পরিস্কার করতে করতে হারানির মায়ের চোখে জল এসে গেল।তার হারানি ,ছোট্ট পাঁচ বছরের হারানির জন্য এবার একটাও জামা সে পাঠাতে পারলো না।ট্রেন বন্ধ যে।দেশ থেকে নকুড়দা এসে তার বুড়ি মায়ের শাড়ি আর ছোট্ট মেয়েটার জন্য জামা নিয়ে যায় গত চার বছর ধরে। কিন্তু বাবুর বাড়ি এবার তো সে আসতে পারে নি ট্রেন বন্ধ বলে।তার পঙ্গু মেয়েটা বুড়ি দিদার কাছে খুব কাঁদছে নিশ্চয়ই।তার কাছে না আছে ফোন,না আছে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা।গত দু'মাস আগে একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করে নকুড়দা এসে টাকা নিয়ে গেল ব্যস্ ।আর কোন খবর নেই। ওরা যে কি কষ্টে আছে কে জানে! এখানে ছুটি তো দেয় না। ছুটি নিলেই কাজটাই চলে যাবে যে!
চোখের জলে দুগ্গা মাকে ডাকে আর বলে,আসছে বছর আবার এসো মা, গরিবের দুঃখ ঘুচিয়ে দিও মা। এ রোগজ্বালা বিদেয় করো মা।
(ক্রমশঃ)
*********************************
Comments
Post a Comment